কক্সবাংলা ডটকম(৩০ নভেম্বর) :: দেশের গ্রামীণ, ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ের সড়কগুলোর উন্নয়ন ও সংস্কারের দায়িত্বে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। তবে নতুন যেকোনো সড়ক উন্নয়ন করতে হলে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সিদ্ধান্তের আলোকে সেগুলোর নিজস্ব আইডি থাকতে হয়।
নতুন প্রকল্প গ্রহণের জন্য তাই আরো প্রায় ৭৯ হাজার কিলোমিটার সড়কের আইডি বা মালিকানা চাচ্ছে এলজিইডি। যেগুলো মূলত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের (এলজিআই) কাছে রয়েছে। এসব সড়ক উন্নয়নে অবশ্য কৃষিজমিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছে পরিকল্পনা কমিশন।
সড়কের কেবল সংখ্যাগত দিক বিবেচনায় না নিয়ে গুণগত বিষয়ে নজর দেয়ার পরামর্শ যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের। তাছাড়া দেশে আদৌ এত পরিমাণ সড়কের প্রয়োজন রয়েছে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
কেননা যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া যেখানে সেখানে সড়ক হলে পরিবেশের জন্য হুমকি। পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক এ সড়ক সংস্কার করতে গিয়ে বড় ধরনের আর্থিক চাপও তৈরি হবে। তাই ১০টির পরিবর্তে মানসম্পন্ন একটি সড়ক নির্মাণ করলে বেশি রিটার্ন আসবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পরিকল্পনা কমিশনের সূত্রমতে, এলজিইডির অধীনে বর্তমানে ১ লাখ ৬৪ হাজার সড়ক রয়েছে, যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৩ লাখ ৭৪ হাজার কিলোমিটার। নতুন করে আরো ৬৪ হাজার ২৪৭টি সড়কের আইডি চেয়েছে এলজিইডি, যার দৈর্ঘ্য ৭৮ হাজার ৮৫৩ কিলোমিটার। ৫৮টি জেলার এসব সড়ক এলজিআইও চাচ্ছে নিজেদের মালিকানায় রাখতে।
সড়কের মালিকানা ও বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে একটি স্ট্যান্ডিং কমিটি কাজ করছে। তবে এলজিইডির নতুন প্রস্তাব করা সড়কগুলোর উন্নয়নের কারণে কৃষিজমির ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে কমিটি। এমনিতেই নানা কারণে দেশে কৃষিজমি উল্লেখযোগ্য হারে কমছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এলজিইডি মূলত গ্রামীণ কাঁচা বা ইটের রাস্তার উন্নয়ন করে। সেক্ষেত্রে পাঁচ-ছয় ফুটের এসব সড়ককে তারা প্রথম ধাপেই ১০ ফুট প্রশস্ত করে, পর্যায়ক্রমে যা ১২-১৮ ফুট পর্যন্ত সম্প্রসারণের সুযোগ থাকে।
তাছাড়া ১০ ফুট করতে গেলেও এসব রাস্তার ঢাল থাকে আরো ১০ ফুটের মতো। অর্থাৎ দুই পাশে পাঁচ ফুট করে জায়গা নিতে হয় সড়কের স্থায়িত্বের জন্য। আবার এসব ভূমি উঁচু ও প্রশস্ত করা হয় পাশের জমির মাটি কেটে। ফলে ১০ ফুট সড়কের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় একই পরিমাণ কৃষিজমি।
এসব কারণে গণহারে সড়কের আইডি না দিয়ে কিছুটা যাচাই-বাছাই করতে চাইছে পরিকল্পনা কমিশন। যদিও বিপুল এ রাস্তা পরিদর্শনের সুযোগ কম বলে মনে করছেন দায়িত্বশীলরা। এ সুযোগে অপ্রয়োজনীয় কিংবা স্বল্প প্রয়োজনীয় সড়ক ঘিরে প্রকল্প নেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে কমে যেতে পারে দেশের কৃষিজমি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এলজিইডি ২০২২ সালে মোট ৯ হাজার ৯৫ কিলোমিটারের ৬ হাজার ২৫৭টি গ্রামীণ সড়ক তাদের অধীনে তালিকাভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিল। একনেক পরে তা অনুমোদন দেয়। ২০২১ সালে সরকারের অন্যতম বৃহৎ এ প্রকৌশল সংস্থা ২ হাজার ৫৯৩ কিলোমিটারের ১ হাজার ৭০০টি পল্লী সড়কের মালিকানা পায়।
তবে ২০১৮-২০ তিন বছর নতুন করে কোনো সড়ক তালিকাভুক্ত করা হয়নি। এবার নির্বাচনের বছর হওয়ায় আগের চেয়ে বেশি পরিমাণ সড়কের আইডির চাপ আসছে বলে মনে করছেন পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা। কারণ ভোটের আগে-পরে অনেক জনপ্রতিনিধি এলাকায় নতুন রাস্তা করার প্রতিশ্রুতি দেন।
যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই যেখানে-সেখানে সড়ক নির্মাণ হলে তা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন পরিকল্পনাবিদরা।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘গ্রামীণ অবকাঠামোয় এমনিতেই অপরিকল্পিত সড়ক বেশি। এমনকি দু-একটি বাড়ির জন্যও রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। যথাযথ পরিকল্পনা ছাড়া হাওরেও সড়ক তৈরি করা হয়েছে। তাই প্রয়োজন বিবেচনা না করে আরো সড়ক তৈরি কিংবা উন্নয়ন করলে বড় ধরনের আর্থিক চাপ তৈরি হবে।’
গ্রামীণ সড়কের যথাযথ বিন্যাস বা সংযোগ ঠিকমতো হয় না বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। গ্রামবাসীর চাঁদার টাকায় কিংবা গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) এবং গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিটা-কাবিখা) কর্মসূচির আওতায় বেশির ভাগ রাস্তা নির্মাণ করা হয়। পরে সেগুলোর ওপর নতুন করে সড়ক হওয়ায় সেগুলোর বিন্যাস ও পরিকল্পনা ঠিক থাকে না বলে মনে করছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক।
তিনি বলেন, ‘সংখ্যাগত দিক দিয়ে চিন্তা না করে সড়কের গুণগত দিক নিয়ে ভাবতে হবে। ১০টি সড়ক না করে এমন একটি সড়ক করা উচিত যেটি বেশি রিটার্ন দেবে। মোটাতাজা করলেই সড়কের প্রডাক্টিভিটি বাড়ে না। মোড়গুলো প্রকৌশলগতভাবে সুবিন্যস্ত হতে হয়। তা না হলে ভবিষ্যতে সমস্যা তৈরি হবে।’ তাই সেসব দিক বিবেচনায় রেখে সড়ক নির্মাণের পরামর্শ এ যোগাযোগ বিশেষজ্ঞের।
অনেক দেশের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সব গ্রামীণ সড়ক পাকা করে না বলে জানান এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) মো. আলি আখতার হোসেন। দেশে এত বেশি সড়কের প্রয়োজন নেই মন্তব্য করে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমারাও গণহারে সড়ক নির্মাণ করতে চাই না। তবে এসব ক্ষেত্রে সরকারের পলিসি লেভেল থেকে কাজ করতে হবে। আগে ঢাকা থেকে গ্রামীণ সড়কের আইডি চাওয়া হতো। এখন একদম উপজেলা পর্যায় থেকে প্রস্তাব আসছে, যা জেলা কার্যালয় হয়ে মন্ত্রণালয় ঘুরে আমাদের কাছে আসে।’ এসব সড়ক উন্নয়ন হলে ফসলি জমির ক্ষতি হবে বলে মনে করছেন এলজিইডির এ কর্মকর্তাও।
প্রয়োজনীয়তা যাচাই না করে প্রস্তাবিত সড়কের আইডি দেয়া হবে না বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
সরকারের অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারক প্রতিষ্ঠানটির ভৌত ও অবকাঠামো বিভাগের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, ‘যেখানে-সেখানে রাস্তা হলে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে। ক্ষতি হবে কৃষিজমির। এমনিতেই আমাদের ভূমির স্বল্পতা রয়েছে। আবার রাস্তারও প্রয়োজন রয়েছে। তাই সব দিক বিবেচনায় নিয়ে কমিটি কাজ করছে। স্থানীয়ভাবে যাচাইয়ের পর যেগুলো প্রয়োজন সেগুলোকেই আগে আইডি দেয়া হবে।’
Posted ৯:২০ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৩
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta